দরিদ্রতার অন্ধকার সফলতা তীব্র বাসনা কে দমন করতে পারে না। তার তীব্র চেষ্টার দাপটে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সামাজিক গন্ডি বন্ধন, তাকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিলেন পশ্চিমবাংলার পুরুলিয়ার ছেলে World Photographer Vicky Roy.
চরম দুঃখ ও যন্ত্রণা পূর্ণ জীবন থেকে World Photographer তৈরি হওয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ কাহিনী আজ আপনাদের জানাবো।
প্রতিভা আর চুলকানি দুটোকেই আটকে রাখা সম্ভব। Vicky Roy তার ই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। পুরুলিয়ার অতি দরিদ্র পরিবারে Vicky Roy এর জন্ম হয়। তার বাবা-মা এতটাই গরিব ছিল যে ঠিকমতো তার লালন-পালন করতে না পেরে তাকে মামার বাড়িতে রেখে আসেন। সেখানে Vicky -র সাথে খুব খারাপ ব্যবহার চলতে থাকে, তাকে তার মামা মামী খুব অল্প খেতে দিত, অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কারণে অকারণে প্রহার করত। সেই কষ্টের জীবন সহ্য করতে পারেনা VicKy Roy.
বয়স যখন এগার বছর একদিন সে সিদ্ধান্ত নিল, সেই এই খাঁচা থেকে মুক্ত হবে, এই চার দেওয়ালের মধ্যে বিকি রায় থাকতে চাইলেন না মামার পকেট থেকে 900 টাকা চুরি করে ট্রেনে উঠে পারি দিল অজানা পথে। চোখে একটাই স্বপ্ন কিছু করতে হবে পৃথিবী দেখতে হবে।
চলতে চলতে পৌঁছে গেল দিল্লিতে ট্রেন থেকে নামল সে চারিদিকে ঘুরে দেখল সে জন অরন্য, এই জন অরন্য সে আগে কখনো দেখেনি, সবকিছু জানা অজানা মনে হল ভয় করতে লাগলো তার, কি করবে কোথায় যাবে কী খাবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না সে, শুধুমাত্র দু চোখের কোনায় তার অশ্রু বেরিয়ে এলো।
এখানকার স্থানিয় স্টেশনের কিছু ছেলেরা যারা নোংরা আবর্জনা কুড়িয়ে সেগুলো দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা একটি অনাথ আশ্রমের দিয়ে আসে ভিকি রায় কে। ভালো খাবার পেল সে কিন্তু সে খানিকক্ষণ পর লক্ষ্য করল যে তাদের বাইরে যাওয়া আটকানোর জন্য গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। ছোট্ট সেই ছেলেটি ভাবলো যে সে হয়তো কোন ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। সেখান থেকে কৌশলে বেরিয়ে পুনরায় আবার স্টেশনে পৌঁছালো সে, আবার সেই ছেলেদের সাথে তার দেখা হলো, তাদের যা কাজ ছিল পুরনো বোতল কুড়িয়ে আনা এবং তাতে ঠান্ডা জল ভরে স্টেশনে বিক্রি করা সেই কাজই করতে লাগল সেই ছোট্ট ভিকি রায়। এখানেও সে শান্তি পেল না এই কাজটি ভিকি কে একটি দাদার আন্ডারে করতে হতো, এই কাজ করে যা টাকা হতো সেই টাকা ওই দাদাকে দিলে তার বিনিময় সে পেটপুরে খেতে পেতো।
ছেলেটি ভাবলো এটাই তার জীবন এটার জন্য কি সে সবকিছু ছেড়ে এসেছে? এই স্টেশন থেকে তাকে বের হতেই হবে সেখান থেকে একদিন সে বেরিয়ে এল। খানিকটা রাস্তায় যাওয়ার পর সামনে একটি খাবারের দোকানে এসে কাজ পেয়ে গেল একটি, বাসন ধোয়ার কাজ।
সেই ছোট বাচ্চা ছেলেটি মতে এটি ছিল তার জীবনের সবথেকে দুঃখের সময়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কনকনে ঠান্ডা জলে বাসন ধুতে হতো তাকে, হাতে ইনফেকশন হয়ে যেত তবুও তার কাজ বন্ধ হতো না।
সামান্য মলম লাগিয়ে দিত না কেউ, ছয় মাস একটানা কাজ করার পর একজন দয়ালু ব্যক্তির সামনে এসে পড়ল ভিকি, সে বলল তোমার তো এখন কাজ করার বয়স না তোমার তো এখন পড়াশোনা করার বয়স, এই বলে তাকে একটি চাইল্ড হোমে নিয়ে গেল সেই ব্যক্তি, ভিকি জানায় যে সে পড়াশোনা করতে খুবই ভালবাসে তার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে রয়েছে তাই তাকে পড়াশোনা করার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। সেই ছোট্ট বাচ্চাটি প্রত্যেক ক্লাসে ৮০% এর উপরে মাক্স নিয়ে পাস করতে শুরু করলো, কিন্তু মাধ্যমিকে তার রেজাল্টটা একটু খারাপ হয়ে যায় ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফির ওপর তার খুব মনোযোগ ছিল খুব ইচ্ছে ছিল।
ফটোগ্রাফির ক্লাস সে খুব মন দিয়ে করত এবং সে তার শিক্ষককে ও জানায় যে তার এই বিষয়টি পড়তে খুবই ভালো লাগে। সেই সময় ওর স্কুল থেকে এক ফটোগ্রাফির প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।
বিখ্যাত সব ফটোগ্রাফাররা সেখানে আসেন তার সাথে আসেন পৃথিবীর বিখ্যাত ফটোগ্রাফার বিগার বেঞ্জামিন। সে ভিকি কে ফটোগ্রাফির বিষয়ে শিক্ষা দিতে শুরু করে। তাতে খুব একটা সুফল হলো না তার কারণ সেই ছেলেটি ইংরেজিতে খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু ফটোগ্রাফির কাজ শেষ চালিয়ে যেতে থাকে। এদিকে 18 বছর হয়ে যাওয়ার পর সালাম ট্রাস্ট তাকে ছেড়ে দিতে হয়।
এই সময়ে একটি স্টুডিওতে কাজ নাই যেখানে বেতন ছিল মাত্র 3000 টাকা। এখানে থাকাকালীন সে থাকার জন্য একটি রুম নেয় যার প্রত্যেক মাসের ভাড়া ছিল 2500 টাকা এবং বাকি 500 টাকা দিয়ে সে খাবার খরচা চালাতো। কিন্তু এটুখানি টাকাতে তার চলত না তাই সে হোটেলের ওয়েটারের কাজ করা শুরু করল।
2007 সালে যখন তার বয়স হল 20 বছর, সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে স্ট্রিট ড্রিম নামে একটি ফটো প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন, সেখান থেকেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ফটোগ্রাফির জন্য ব্রিটেনের, ভিয়েতনাম, আমেরিকা বিভিন্ন জায়গা থেকে তার ডাক আসা শুরু হয় এবং সে একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি পায়।
নাইন ইলেভেনে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল তার রিকনস্ট্রাকশন এর ফটো তোলার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়, ভারতে ফিরে আসার পর সালাম ট্রাস্ট তাকে ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফার ফর ইমপ্রিফিল অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
2013 খ্রিস্টাব্দে আটজন ফটোগ্রাফারকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে তিনি ছিলেন একজন বর্তমানে ভিকি তার মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছে। এবং তাদের সমস্ত দায়-দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে। আজ তিনি প্রতিষ্টিত এবং সম্মানিত ও অর্থবান একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার।
রাস্তার ছেলে যার থাকার জায়গা ছিল না, যে খেতে পেতো না, স্টেশনে যে রাত কাটাতো, তার জীবনের ঘটনা আমি আপনার সামনে আজকে তুলে ধরলাম, সেটি দেখে একটি শিক্ষা নেওয়া উচিত কারণ সবাই সোনার চামচ নিয়ে জন্মায় না রাস্তায় পড়ে থাকা কাঁচের টুকরোর মধ্যে কিন্তু থাকতে পারে হিরে, কিন্তু সেগুলোতে আমরা নিজেরাই পায়ে ঠেলি, তাই আমাদের উচিত নিজের লক্ষ্যকে স্থির রাখা এবং যতই বিপদ আসুক না কেন তার থেকে সরে না আসা এবং সেটিকে পূরণ করার শক্তি রাখা।