মহাত্মা বিদুরের কিছু নীতি বাক্য আজকে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। মহাত্মা বিদুরের নীতি বাক্য গুলো শুনলে আপনার বাস্তব সম্পর্কে অনেক ধারণা তৈরি হবে। আটটি মহৎ গুণের কথা মহাত্মা বিদুর ব্যাখ্যা করেছেন। সেই আটটি গুণ হলো :- ১. বুদ্ধিমত্তা, ২. কুলিনতা, ৩. ইন্দ্রিয় নিগ্রীহতা, ৪. স্বাস্থ্য জ্ঞান, ৫. পরাক্রম, ৬. অল্প বচন, ৭. দান ভাবনা, ৮. কৃতজ্ঞতা

প্রথম যে কথাটির বিষয়ে মহাত্মা বিদুর বলেছেন সেটি হল বুদ্ধিমত্তা। বুদ্ধিমত্তা বলতে ইনফর্মেশন গাদার করা নয় বুদ্ধিমত্তা বলতে কমনসেন্স কে বোঝানো হয়েছে। যে অতিরিক্ত পরিমাণে তথ্য সংগ্রহ করে তাকে প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিমান বলা যায় না। এই ব্যক্তির মধ্যে এবং কম্পিউটারের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। যে এই তথ্যকে নিজের জীবনের উন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগায়, সে প্রকৃত বুদ্ধিমান।

এই বিষয় সম্পর্কে একটি গল্প আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই, এক গ্রামে চারজন বন্ধু বসবাস করত তারা শিক্ষা অর্জনের জন্য দূরে একটি বিদ্যালয়ে যায়। এবং মনোযোগ সহকারে বিদ্যা অর্জন করতে থাকে। এর মধ্যে প্রথম বন্ধুটি যে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটি হলো সব হারকে কিভাবে জোড়া লাগানো যায়। এবং দ্বিতীয় বন্ধু যে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটি হলো এই হারে কিভাবে মাংস জোড়া দেওয়া যায়, তৃতীয় ব্যক্তি যে শিক্ষাটা গ্রহণ করে সেটি হলো এই যে যে মৃত কোন পশুর মধ্যে সে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে। কিন্তু যে চতুর্থ বন্ধুটি থাকে সে বাস্তব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে সে এরকম অবাস্তব জ্ঞান অর্জন করলেন না। যাইহোক বিদ্যা সম্পূর্ণ অর্জন করার পর তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

বাড়ি আসার সময় তারা একগুচ্ছ হার দেখতে পায় এবং প্রথম ব্যক্তি বলে যে আমি যেই বিদ্যা অর্জন করেছে সেই বিদ্যা দ্বারা এই হারগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি দেখি আমি আমার বিদ্যা সম্পূর্ণভাবে অর্জন করতে পেরেছি কিনা।
তারপর ওই হাড় গুলোর উপরে তার বিদ্যা প্রয়োগ করে এবং দেখতে দেখতে সেই হারগুলো জোড়া লেগে যায়। দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে আমি আমার বিদ্যা প্রয়োগ করে দেখতে চাই যে এই জোড়া লাগা হাজারের উপরে আমি মাংস আনতে পারি কিনা এবং সে তার বিদ্যা প্রয়োগ করে দেখতে দেখতে ইচ্ছে করে মাংস চলে আসে। মাংস সঞ্চার হওয়ার পরে দেখা যায় যে সে পশুটি হল আসলে একটি বাঘ।

তৃতীয় বন্ধু তার বিদ্যা প্রয়োগ করতে যাবে তখনই চতুর্থ বন্ধু বারণ করেন। এবং বললেন বন্ধু তুমি নিজের বিদ্যা এই মৃত বাঘ টির ওপর প্রয়োগ করে তাকে জীবিত করো না। কারণ এই পশুটি একটি বাঘ , ও যদি একবার জীবন্ত হয়, সবার প্রথমে আমাদেরকে খেয়ে ফেলবো। তৃতীয় বন্ধুটি তার কথা একদমই শুনলেন না এবং বললে আমি আমার বিদ্যা অবশ্যই প্রয়োগ করবো যেহেতু আমি ওর জীবন বাঁচাচ্ছি ও আমার কখনোই খাবে না। যখন চতুর্থ ব্যক্তিটির দেখলেন যে তার কথা কেউ শুনছে না তখন সে একটি গাছে উঠে বসে পড়ে তার নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এবং তার গাছে ওঠা দেখে তার বাকি বন্ধুরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করে। তৃতীয় বন্ধুটি ঐ বাঘটির ওপর নিজের বিদ্যা প্রয়োগ করে এবং দেখতে দেখতে বাড়তি জীবিত হয়ে যায়। সাথে সাথেই এই ধূর্ত বাঘটি সেই তিন বন্ধুকে মেরে ফেললো এবং বনের দিকে পালিয়ে গেল।

চতুর্থ বন্ধুটি সেই গাছ থেকে নেমে আসলো এবং কাঁদতে কাঁদতে সেই শিক্ষকের কাছে গেল যে তাদেরকে এই বিদ্যা গুলি শিখিয়ে ছিলেন। গুরুজি বললেন যে আমি যেকোনো একজনের প্রাণ বাঁচাতে পারবো তুমি বলো তুমি কাকে বাঁচাতে চাও তখন ওই চতুর্থ বন্ধুটি বলল যে আপনি আমার এই তৃতীয় বন্ধুটির জীবন বাঁচান।

গুরুজি বললেন যে তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান তখন সেই তৃতীয় ব্যক্তির প্রাণ বাচালেন গুরুজি এবং তৃতীয় ব্যাক্তিটি তার আর দুই বন্ধুর প্রাণ ফিরিয়ে আনলো এবং তারা তারপর নিজেদের গ্রামের দিকে রওনা দিলেন।

এই গল্পটির দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী যারা কমনসেন্স দিয়ে কাজ করে এবং নিজেদের বিদ্যাকে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করে।

দ্বিতীয় হল কূলিনতা, এই শব্দটির অর্থ হল ভদ্র ব্যবহার। একজন ব্যক্তির ব্যবহার দাঁড়ায় তার আত্মপরিচয় প্রকাশিত হয়। আর তার ব্যবহার দ্বারাই বোঝা যায় ওই ব্যক্তি কোন পরিবার থেকে এসেছে।

তৃতীয়টি হলো ইন্দ্রিয় নিগ্রীহতা তারাই জীবনকে নিজেদের বষভর্তি করতে পারে যাদের এই গুণটি রয়েছে। কোন একটি কর্ম বা বিষয়ের প্রতি ইন্দ্রিয় আমাদের আকর্ষণ করে, এই ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ করার পর আমাদের ভবিষ্যতে অনেক রকম অসুবিধার মুখমুখি হতে হয়। যারা ইন্দ্রিয়সুখ কে জীবনের একমাত্র সুখ হিসেবে মনে করে তারা ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে চলে যায়। তাই বিদুর জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্ম ঈন্দীয় গুলোকে নিজের বশে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ঈন্দ্রীয় গুলি ব্যবহার করার মানে এটাই যে চোখে যতটুকু দেখা উচিত ততটাই দেখা ভালো এবং কানের যতটুকু শোনা উচিত ততটুকুই শোনা ভালো। জিহ্বা দ্বারা অতিরিক্ত স্বাদ গ্রহণ করা উচিত নয় এবং ত্বকের দ্বারা ততটাই অনুভব করা উচিত যত টাতে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আপনি যদি অতীত ঘেটে দেখেন তাহলে দেখতে পারবেন শিক্ষিত ও মহান ব্যক্তিরা কেবলমাত্র এনজিওকে নিজের বশে রাখতে না পেরে, কামতৃষ্ণাকে নিজের বশে না করতে, নিজেদের সম্মানকে নষ্ট করে ফেলেছেন। তাই ইন্দ্রীয়কে বশে রাখা খুবই দরকার নয় তো আপনাকে ভবিষ্যতে পস্তাতে হতে পারে।

চতুর্থত হলো শাস্ত্র জ্ঞান, একজন সাধারন মানুষকে অসাধারণ করে তুলতে পারে শুধুমাত্র শাস্ত্র জ্ঞান। মহাত্মা বিদুর শাস্ত্র জ্ঞান বলতে সাবজেক্ট নলেজের কথা বলেছেন। যে যেই বিষয়ে এক্সপার্ট তার সেই বিষয়ে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরী। জ্ঞান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জগতে সম্মান বৃদ্ধি পায়। তাইতো চাণক্য বলেছে “বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে জগতে”। তাই আমাদের সবসময় জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

পঞ্চম হলো পরাক্রম। একজন ব্যক্তি তখনই একটি অসাধারণ ব্যক্তি তে পরিণত হয়, যখন তার মধ্যে পরাক্রম থাকে। এখন প্রথমে আমাদের পরাক্রম শব্দটির অর্থ জানা দরকার। “পরা” শব্দের অর্থ হলো বিপরীত মানে হচ্ছে বিপরীত দিক এবং “ক্রম” শব্দের অর্থ হলো এগিয়ে যাওয়া। এটি যদি সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে এটার মানে হল যে ব্যক্তি প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখে। এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ফাইট করে এবং আগে এগিয়ে যায় তাকে পরাক্রমী বলে। একজন সফল ব্যক্তি হতে গেলে পরাক্রমি হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ষষ্ঠ বিষয় হলো অল্প বচন। অল্প বচন মানে মহাত্মা বিদুর বোঝাতে চেয়েছেন যে কথা বলার সময় মানুষ আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠে আর তখনই তার গোপন কথা গুলি বেরিয়ে আসে তাই বেশি কথা বলা উচিত না যদি আমরা বেশি কথা বলি তাহলে আমাদের গুরুত্ব নষ্ট হয়ে যায় এবং নিজেদের গোপনীয়তা সামনে চলে আসে তাই সব সময় বুঝে অল্প কথা বলতে হয়।

সপ্তম বিষয়টি হলো ক্ষমতা অনুযায়ী দানশীলতা। যারা মহান ব্যক্তি তারা দান গ্রহণ করার জন্য মহান হয়নি তারা দান করার জন্য মহান হয়েছে। কিন্তু দান বলতে অর্থ কী বোঝায় না দান বলতে বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান, খাদ্য এগুলোকেও বোঝায়। এবার আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে কাকে দান করা দরকার এবং কতখানি দান করা দরকার। তাহলে বলব যে যার সত্যিই দানের প্রয়োজন এবং যে এই বিষয়টির মূল্য আপনাকে বোঝাবে তাকেই দান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রকৃত সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা প্রয়োজন কখনো নিজের সামর্থের বাইরে গিয়ে দান করবেন না তাহলে আপনি অসময় বিপদে পড়বেন।

অষ্টম এবং শেষ যে পয়েন্টে আলোচনা করব সেটি হল কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা বলতে বোঝায় যে উপকারীর উপকার স্বীকার করা। সর্বদা আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর উপকারের মূল্য দেওয়া উচিত।মহতমা বিদুর এই আটটি জ্ঞানের কথা বলেছেন। যদি আপনি নিজের জীবনে সঠিক বিচার করতে চান কে আপনার বন্ধু এবং কে শত্রু তার বিচার করতে চান এবং নিজেকে একটি সম্পূর্ণ জ্ঞানী ব্যক্তিতে পরিণত করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই এই নীতি গুলি মেনে নিতে হবে এবং আশা করবো আপনি জীবনের পথে অবশ্যই সফল হবেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।